উন্নত বিশ্বের বাজেট সংকোচন, উন্নয়নশীল দেশসমূহের এনজিওগুলোর জন্য একটি বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশসমূহ এই সমস্যা সমাধানে খুব বেশী সহযোগিতা করছে তা নয় উপরন্ত তাদের কেউ কেউ এনজিওগুলোর বিশেষকরে মানবাধিকার নিয়ে যারা কাজ করছে তাদের উপর দমন প্রতিনিয়ত বাড়াচ্ছে।
মানবাধিকার বিষয়ে অর্থায়ন নিয়ে চলমান বিতর্কে এখন পর্যন্ত আমরা দেখেছি যে, সাসকিয়া ব্রেছেনম্যাছের ও থমাস ক্যারোথারস আলোকপাত করেছেন কিভাবে এই বাজেট সংকোচনের বিষয়টি সাড়া বিশ্বে একটি সাড়া জাগানো ঘটনায় পরিণত হয়েছে। মেধা পাটেকার এবং লেনিন রাঘুভানশি আলোচনা করেছেন ভারত সরকারের বিদেশী অর্থায়নের প্রতি ভীতির বিষয়টি, টর হ্যাডেনফিল্ড তথ্য দিয়েছেন যে, ইথিওপিয়াতে বিদেশী অর্থায়ন অপরাধে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে ম্যাইনা কিয়াই দেখিয়েছেন কেনিয়া কিভাবে বিদেশী অর্থায়ন এড়িয়ে গেছে।
এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা “বিদেশী অনুদান স্বেচ্ছাসেবী কার্যকর আইন ২০১৪” খসড়া অনুমোদন করেছে এবং খুব শীঘ্রই সংসদে পাশ হবে। এনজিওগুলো এই আইনকে কঠোর ও নির্মম বলে আখ্যায়িত করেছে এবং এটি এমন সময়ে অনুমোদিত হলো যখন দেশে ভিন্নমত পোষণের সুযোগ সংকোচিত হয়ে যাচ্ছে।
মন্ত্রিসভা অনুমোদিত আইন অনুসারে এখন সরকার বিদেশি অর্থায়নে এনজিও কর্মসূচি অনুমোদনের ক্ষেত্রে সীমাহীন সময় নিতে পারবে, কর্মসূচি পরিবর্তন করতে পারবে, আইনের পরিপন্থি হলে এনজিও বন্ধ করে দিতে পারবে। এছাড়াও, নতুন আইন হলে আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা আরও একদফা বাড়বে কারণ, এনজিওগুলোকে প্রত্যেক ৫ বছর পরপর নিবন্ধন নবায়ন করতে হবে যা পূর্বে করতে হতো ১০ বছর পর এবং প্রত্যেক মাসে সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয় বৈঠক করতে হবে।
বাংলাদেশের এনজিওগুলোর নতুন আইন সম্পর্কে মনোভাব জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ শাখার নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “যখন আমরা সব এনজিওগুলোর জবাব দেওয়ার পক্ষে, তখন শুধু আইনের নতুন ধারা সমূহ নয় এর সাধারন ভাষাও আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই আইনটা যতটা না সহায়তাকারী তার চেয়ে অনেক বেশী নিয়ন্ত্রনকারী”। প্রস্তাবিত নতুন আইনের সারমর্ম একটি বড় সমস্যার ভগ্নাংশ মাত্র। এই আইন প্রস্তাবনার জন্য যে সময়টা বেছে নেয়া হয়েছে সেটা ভীতিজনক কারণ এখন দেশের সরকার একটি প্রশ্নবোধক রায়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে এবং ক্রমবর্ধমানভাবে বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করছে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গত বছরের বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সকল বিরোধী দল গত নির্বাচন বর্জন করে এবং অর্ধেকের বেশী সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। একই সাথে সরকার ক্ষমতা দির্ঘায়িত করার জন্য সমালোচক তা সে যেই হোক না কেন,--বিরোধী দল, সংবাদ মাধ্যম, সুশীল সমাজ—সবারই কন্ঠরোধ করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, উল্লেখ্য যে,সরকার এরই মধ্যে গণমাধ্যমের ক্ষমতা ও অনলাইন নজরদারীতে, নিয়ন্ত্রনে নতুন আইন পাশ করেছে, সংবিধান সংশোধন করে জাতীয় সংসদকে সুপ্রীম কোর্টের বিচারকদের অপসারণ করার সাংবিধানিক ক্ষমতা দিয়েছে। দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম এর মত ঘটনা আশংকাজনকভাবে বাড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগের অঙ্গুলি আইন শৃংখলা বাহিনীর দিকে নির্দেশিত হচ্ছে।
২০১৩ সালের পর ক্রমবর্ধমান সহিংসতার জন্য বাংলাদেশের রাজনীতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ঐ সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়কদের বিচারের একটি রায়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজ ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্ম বিশ্বাসের প্রশ্নে স্পষ্ট বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথমে ফেব্রুয়ারিতে মূলত সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারী ধর্ম নিরপেক্ষ তরুণরা “যুদ্ধাপরাধীদের”সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগ আন্দোলন নামে সাড়া জাগানো আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তীতে কিছুদিনের মধ্যে ধর্মীয় আলেম সমাজ ও মাদ্রাসা ছাত্ররা হেফাজত ই ইসলাম নামক ধর্মীয় সংগঠনের ব্যানারে জমায়েত করে শাহবাগ আন্দোলনকারীদের বক্তব্য সমূহ যা তাদের ভাষায় অবমাননাকর তার প্রতিবাদ করে।
হেফাজতের জমায়েত ছত্রভঙ্গ করতে সরকারি বাহিনী বল প্রয়োগের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় মানবাধিকার এনজিও অধিকার, যারা বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড এবং আইন শৃংখলা বাহিনীর অপতৎপরতা তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে,সরকারের রোষের শিকার হয়।
Demotix/ibrahim ibrahim (All rights reserved)
Odhikar’s Secretary, Adilur Rahman Khan.
এখানে উল্লেখ্য যে, অধিকার বৈদেশিক আইন খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার অনেক আগে থেকেই বিদেশি অর্থ দান সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিতর্কের মধ্যে ছিল।
এক ধর্মীয় ছুটির রাতে অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমানকে আটক করা হয়,আইন শৃংখলা বাহিনী তার অফিসে তল্লাশি চালিয়ে কম্পিউটার এবং অন্যান্য কাগজপত্র জব্দ করে। সরকারি আইনজীবীরা আদিলুরকে নতুন প্রবর্তিত বিতর্কিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের আওতায় বিকৃত তথ্য ও ছবি প্রকাশের দায়ে অভিযুক্ত করে।
এখানে উল্লেখ্য যে, অধিকার বৈদেশিক আইন খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার অনেক আগে থেকেই বিদেশি অর্থ দান সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিতর্কের মধ্যে ছিল। আদিলুর ২০১২ সালে এক সাক্ষাতকারে এই আইন সম্পর্কে সতর্ক বার্তা উচ্চারণ করে বলেন, “প্রস্তাবিত আইনটি মুক্তচিন্তা ও স্বাধীনভাবে মত প্রদানের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবে এবং মানবাধিকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলির উপর আরও নিয়ন্ত্রন বাড়াবে”। প্রকৃত পক্ষে আইনটি ভিন্নমত নিয়ন্ত্রনে আরও একটি সরকারি হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
সময়ের সাথে সাথে অবস্থার আরও অবনতি ঘটে, ২০১৪ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের সময় কিছু মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সরকারের এরকম একটি নির্বাচনে যাওয়ার পদক্ষেপের সমালোচনা করেন।গত কয়েক মাসের ক্রমবর্ধমান সহিংস ঘটনা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্ববর্তী ঘটনা সমূহ স্মরন করিয়ে দেয়। বিরোধী দলীয় জোটের জানুয়ারি-মার্চ মাসের সড়ক-নৌ-রেলপথ অবরোধ কর্মসূচীর সময়ের দেশব্যপী সহিংসতায় কমপক্ষে ১৩০ জনের প্রাণহানি ঘটে।
বাংলাদেশ এনজিওগুলোর উর্বর ভূমি গত চার দশকে এদেশে এনজিওগুলো দারিদ্র দূরীকরণ ও অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে এই সাফল্যের ন্যায্য এবং অন্যায্য দুই ধরনের সমালোচনায় বিদ্যমান আছে। এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও তহবিল অব্যবস্থাপনা, ধর্মীয় মৌলবাদী তৎপরতায় অর্থ যোগানো ইত্যাদি নিয়ে পাশ্চাত্যের পক্ষ থেকে সরকারের উপর বিদেশী অর্থায়নে নজরদারি বাড়ানোর চাপ আছে। তাই বিদেশী অর্থায়ন ও তার বরাদ্দ নিয়ন্ত্রনে একটি আইন অনেক পুরানো পাওনা ছিল বলে মনে হয়।
দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অর্থায়ন প্রচলিত ফৌজদারি আইনেই নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব ছিল। বিদেশী অর্থায়নের উপর নির্ভরশীল বাংলাদেশি এনজিও গুলো স্বাভাবিকভাবেই অর্থায়নের উৎস হারানোর ব্যাপারে সংকিত। নতুন আইন অনুযায়ী বিদেশী দাতাদের সরকার কতৃক প্রজেক্টের যেকোনো পরিবর্তন মেনে নিতে হবে। আইন পাশ হওয়ার পর প্রজেক্ট অনুমোদন যদি বিলম্বিত হয় তাহলে বেসরকারি সংস্থাসমূহ বিদেশী সহায়তা অন্য কোথাও চলে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইনটি যে সংসদীয় কমিটি পর্যালোচনা করছে, তারা সম্প্রতি এনজিও সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, আইনটি পাশ করার সময় এনজিও সম্প্রদায়ের উদ্বেগের বিষয়টি মাথায় রাখা হবে। চূড়ান্ত খসড়ায় উত্থাপিত বেশ কয়েকটি পরিবর্তন বাদ পরার পর ইফতেখারুজ্জামান ও তার সঙ্গীরা এখন খুব বেশি আশাবাদী নন।